মাঝে মাঝে ছোটখাট আবিষ্কার পুরো পৃথিবীর ভাগ্য পাল্টে দেয়। আপাতদৃষ্টিতে একদমই মামুলী কিছু উদ্ভাবন বাঁচিয়ে দেয় লক্ষ লক্ষ রোগীর প্রাণ। যেমন ঊনিশ শতকে ফিলিপাইন অঞ্চলে বেরিবেরি রোগে অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে যেত। যেসব শিশু মারা যেত, তাদের অর্ধেকের মৃত্যুর কারণ হতো এই বেরিবেরি। পুরো একটি দেশ অসুস্থ হয়ে যায় এর কারণে। কিন্তু ছোট একটি আবিষ্কার বাঁচিয়ে দেয় লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ। লাল রঙের চালের উপরের আবরণই পারে এই রোগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে। চালের উপরের একটি আবরণ এই রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে। এই ছোট আবিষ্কারটিই বাঁচিয়ে দেয় লক্ষ লক্ষ মানুষকে।
এরকম আরেকটি আবিষ্কারের উদাহরণ হলো খাবার স্যালাইন। ছোট একটি আবিষ্কার বাঁচিয়ে চলছে সুস্থ করে চলছে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে। কালজয়ী আবিষ্কার করতে হলে উন্নত প্রযুক্তি কিংবা আধুনিক প্রকৌশলের দরকার নেই। যে আবিষ্কার সত্যিকার অর্থেই মানুষের কাজে আসবে, বিনামূল্যে কিংবা অতি স্বল্প মূল্যে মানুষ তাদের ব্যবহার করতে পারবে সেগুলোই তো আসলে সেরা আবিষ্কার, সেগুলোই তো আসলে কালজয়ী আবিষ্কার।
এরকমই একজন আবিষ্কারক হচ্ছেন মোহাম্মদ জুবায়ের চিশতী। নিউমোনিয়া সংক্রান্ত অনেক গবেষণার সাথে তিনি জড়িত। নিউমোনিয়ার উপর তার বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র আছে। অনেক দিন ধরেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন, তার হাতে অনেক শিশু সুস্থ হয়েছে। দেশে বা বিদেশে তার সম্পর্কে তেমন জানাশোনা ছিল না মানুষের। তবে সম্প্রতি নিউমোনিয়া প্রতিরোধে তার উদ্ভাবন নিয়ে বিবিসিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়াতে তিনি আলোচনায় আসেন।
শিশুদের কম শক্তির দেহে নিউমোনিয়া হলে তার ফলাফল হয় মারাত্মক। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯ লক্ষ ২০ হাজার শিশু মারা যায় এতে আক্রান্ত হয়ে। আমাদের জন্য ব্যাপারটা একটু বেশি দুঃখজনক। কারণ আমাদের এবং আফ্রিকান অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ১৯৯৬ সালের দিকে এরকম কিছু শিশুর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন জুবায়ের চিশতী। ইন্টার্নিরত অবস্থায় চোখের সামনে তিনটি শিশুকে নিউমোনিয়ার যন্ত্রণায় মারা যেতে দেখেন। এ ঘটনায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি, তাদের যন্ত্রণা প্রতিরোধে কিছু না কিছু একটা করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তারই ফলাফল আজকের প্লাস্টিক বোতলের চিকিৎসা।
স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া কিংবা আরএসভি ভাইরাসের আক্রমণের ফলে নিউমোনিয়া দেখা দেয়। এতে আক্রান্ত হলে ফুসফুস তরল শ্লেষ্মা দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়, ফলে পর্যাপ্ত অক্সিজেন গ্রহণে সমস্যা দেখা দেয়।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা যে নেই তা বলা যাবে না, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা যে আগেও ছিল না তা-ও বলা যাবে না। তবে সেসব চিকিৎসা ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। উন্নত দেশগুলোতে কৃত্রিম ভেন্টিলেটর ব্যবহার করে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস সচল রাখা হয়। এরকম একটি যন্ত্র কিনতে গেলে ১৫ হাজার ডলার (১২ লক্ষ টাকা) খরচ হয়। আবার এই যন্ত্রটিকে চালাতে গেলেও বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মীর প্রয়োজন হয়। এখানেও অর্থের প্রশ্ন।
খরচ কমাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তাতেও প্রতি সাতটি শিশুর মাঝে একটি শিশু মারা যায়। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে আরো একটি চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে পরিচিত হন। এই পদ্ধতিতে ফুসফুসে লাগাতার বায়ুর চাপ প্রদান করা হয়। ফলে একত্রে জমে গিয়ে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় না ফুসফুসের। যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণের জন্য ফুসফুসকে কৃত্রিমভাবে সচল রাখা হয়। এ পদ্ধতিকে বলা হয় Continuous Positive Airway Pressure বা CPAP। কিন্তু এই পদ্ধতিও বেশ ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের মতো দেশের মানুষেরা এত খরচ করে এই চিকিৎসা নিতে পারবে না। রোগ তো আর ধনী গরীব বেছে বেছে আসে না। যে চিকিৎসাকে অধিকাংশ মানুষ টাকার কারণে গ্রহণ করতে পারবে না, সেটা আর বাস্তবসম্মত চিকিৎসা থাকে কোথায়?
এখানেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন ডা. জুবায়ের চিশতী। অস্ট্রেলিয়ার CPAP পদ্ধতির একটি সরল ও সস্তা বিকল্প তৈরি করার কথা ভাবেন। দেশে ফিরে আই.সি.ডি.ডি.আর.বি (International Centre for Diarrhoeal Disease Research, Bangladesh)-এর হয়ে বিকল্প তৈরির কাজেও লেগে যান। দুই দশক গবেষণার মাধ্যমে সাফল্যও পান। তিনি এবং তার সহকর্মী কিছু ব্যবহৃত শ্যাম্পুর বোতল নেন। সেগুলোতে কিছু পানি ভরেন। বোতলের এক প্রান্তে একটি নল যুক্ত করে দেন। অক্সিজেনের উৎস থেকে শিশু অক্সিজেন গ্রহণ করছে এবং শ্বাস ত্যাগ করছে। ত্যাগ করা শ্বাসটি নাকে যুক্ত পাইপের মাধ্যমে চলে আসছে ঐ পানি ভর্তি বোতলের ভেতর। ফলে বোতলের ভেতরে তৈরি হচ্ছে বুদবুদ। এই বুদবুদ আবার এক উপায়ে ফুসফুসের সাথে যুক্ত। বায়ুর বুদবুদ চাপ প্রদান করে, সেই চাপ গিয়ে লাগে ফুসফুসে। বহির্মুখী চাপের ফলে ফুসফুস সংকুচিত হয়ে যেতে পারে না। এ কারণে শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে এবং ফলাফল স্বরূপ বেঁচে যেতে পারে নিউমোনিয়া থেকে।
খুব বড় ধরনের পরিকল্পনা না করে সাধারণ পরীক্ষার জন্য খেলাচ্ছলে এটি করে দেখেছিলেন। পাঁচটি শিশুর উপর এটি ব্যবহার করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইতিবাচক ফলাফল দেখতে পান। “ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করে অক্সিজেন লাগান এবং খাদ্যনালীতে নল প্রবেশ করান। তারপর গোল বোতলে পাইপের এক অংশ নিয়ে যান, সেখানের পানিতে বুদবুদ শুরু হয়। এভাবে এক পর্যায়ে আমার সন্তান সুস্থতা লাভ করে। এজন্য আমি অনেক খুশি।” এমনই বলছিলেন নিউমোনিয়া আক্রান্ত একটি শিশুর মা।
এরপর তিনি এটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণায় লেগে যান। আগস্ট ২০১১ থেকে জুলাই ২০১৩ পর্যন্ত টানা দু’বছর এটি নিয়ে গবেষণা করেন। সেই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন লেঞ্চেট সাময়িকীতে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয় বোতলের ভেতর বুদবুদ পদ্ধতিতে শিশুর চিকিৎসা করার ফলে মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যায় এবং খরচেও খুব সস্তা। মাত্র একশো টাকার (১.২৫ ডলার) মধ্যেই এটি তৈরি করা সম্ভব, যা গরীব কিংবা উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুব উপযোগী। এই বোতল বুদবুদ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মৃত্যুহার ৭৫% কমে গেছে।
এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ শিশু এই পদ্ধতিতে আরোগ্য লাভ করেছে। পদ্ধতিটির জনপ্রিয়তা বাড়লে এবং সকলের গ্রহণযোগ্যতা পেলে সমগ্র দেশের হাজার হাজার নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুকে এর মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া যাবে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. লুৎফুল কবির বিবিসিকে জানিয়েছেন, এই পদ্ধতি সমগ্র দেশে ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করে দেখা উচিৎ। তবে আপাতত যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা বেশ সন্তোষজনক।
তবে আরো কাজ বাকি আছে। এই পদ্ধতিতে শতভাগ শিশু সুফল পাচ্ছে না। ১০০-এর মধ্যে ৭৫টি শিশু ভালো হচ্ছে, এটি অবশ্যই ইতিবাচক খবর। কিন্তু তারপরেও ২৫টি শিশুর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সাফল্যের এই হার আরো বাড়ানো দরকার। এই পদ্ধতিটি এমন অবস্থায় পৌঁছাতে হবে যেন প্রতি হাজারেও একজন মারা না যায়। এক হাজারের মাঝে এক হাজারই যেন সুস্থতা লাভ করে। এই লক্ষে তিনি এবং তার দল কাজও করে যাচ্ছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশুর মৃত্যু শূন্যের ঘরে নেমে আসবে।